কবরেও পাশাপাশি শরীফ-ফয়েজ

197

জহিরুল ইসলাম জহির  ।একসাথে পথচলা, রাত্রীযাপন ও মৃত্যুর পর পাশাপাশি কবরেই শায়িত হলেন কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের ইছাপুরা গ্রামের ব্যবসায়ী হায়াতের নবী শরিফ (২৮) ও কর্মচারী ফয়েজ আহমেদ পরান (১৮)। ২৮ জুলাই বুধবার বিকাল ৩টায় গ্রামের ইদগাহ মাঠে জানাজা শেষে শরীফদের পারিবারিক কবরস্থানে দু’জনের মরদেহ পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়েছে। চলমান লকডাউনকে উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জানাজায় ২ সহস্রাধিক মুসল্লী অংশগ্রহন করেছেন।

নিহতদের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ইছাপুরা গ্রামের হাছান আহম্মদের একমাত্র ছেলে হায়াতের নবী শরীফ (২৮)। ছোট কাল থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতেন। পারিবারিকভাবে গরু পালন করতেন। প্রথম দিকে বেলঘর বাজারস্থ একটি মুদি দোকানে চাকরি করতেন। গত বছর থেকে বাড়ীতে ছোট পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন শুরু করেন। গ্রামে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসায়ের সহায়তার জন্য কর্মচারী হিসেবে চাকরি দেন একই গ্রামের আবুল হাশেম এর ছেলে ফয়েজ আহমেদ পরান (১৮) কে। মালিক কর্মচারীর ব্যবধান কমিয়ে শরীফ যে কোন কাজে ফয়েজ কে আপন ভাইয়ের মতো আদর করতেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সকল কাজে বিশ্বাস করতেন। নিজে যা খেতেন, ফয়েজকেও খাওয়াতেন। নিজে যেমন পোশাক পরতেন ফয়েজকেও তেমন পরাতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দু’জনের পোশাক একই ডিজাইন ও একই রঙ্গের হতো। প্রতিদিন ব্যবসায়ীক কাজ শেষে শরীফের নিজের কক্ষে একই খাটে দু’জন রাত্রীযাপন করতেন।

গত সোমবার রাতেও দোকান বন্ধ করে দু’জন শরীফের কক্ষেই ঘুমান। ওই রাতে শরীফের মা, বাবা তাদের একমাত্র মেয়ের বাড়ীতে ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় শরীফের মা, বাবা ও বোন বাড়ীতে এসে দেখেন ভিতর থেকে সকল দরজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর ঘরের উত্তর পাশের দরজা ভেঙ্গে তারা ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন শরীফের মরদেহ ঘরের দক্ষিণ পাশের কক্ষের আড়াই (ভুতর) এর সাথে ঝুলন্ত। আর ফয়েজের মরদেহ খাটে। ফয়েজের গলায় হালকা দাগ রয়েছে। নাক মুখ থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে শরীরে লেগে আছে। ওই সময় শরীফের পিতার চিৎকার শুনে গ্রামবাসীও ঘটনাস্থলে আসেন।

স্থানীয় ইউপি মেম্বার দেলোয়ার হোসেন সংবাদ দিলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভির আহমেদ , সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (সদর দক্ষিণ সার্কেল) প্রশান্ত পাল, লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব, ভুশ্চি বাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম, বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের মজুমদার ও লালমাই প্রেসক্লাবের সভাপতি শাহাজাহান মজুমদার ঘটনাস্থলে যান।

জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে সিআইডি ও পিবিআই এর দুটি টিমও ঘটনাস্থলে যান এবং মৃত্যুর বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। এরপর লালমাই থানা পুলিশ দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন। মঙ্গলবার রাতেই শরীফের পিতা হাছান আহমেদ বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে লালমাই থানায় মামলা ( নং ১৪, তাং ২৭/০৭/২০২১ইং) দায়ের করেন।

নিহত শরীফের পিতা হাছান আহমেদ বলেন, পরিকল্পিতভাবেই দু’জনকে হত্যা করা হয়েছে। আমি অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছি। পুলিশ অপরাধীদের সনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিবে।

বেলঘর উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল খায়ের মজুমদার বলেন, শরীফ অত্যন্ত ভাল ছেলে। গ্রামের সবাই তাকে পছন্দ করতো। পরিকল্পিতভাবেই দু’জনকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের সনাক্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হউক।

লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ফয়েজ আহমেদ কে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তার গলায় জখম ও খামচির দাগ রয়েছে। আর শরিফের লাশ ছিল ঝুলন্ত। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এলে ও মরদেহের বিভিন্ন আলামত পর্যালোচনা করে মৃত্যুর মূল কারণ উদ্‌ঘাটন করা হবে।

২৮ জুলাই বুধবার বিকালে কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন,হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। হত্যা মামলাটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কারও কাছে কোন তথ্য থাকলে পুলিশ কে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন।