ওসির কক্ষে আবেগঘন দৃশ্যের অবতারনা!

বিট পুলিশিং: হিন্দু পরিবারের বিরোধ নিরসন

235

স্টাফ রিপোর্টার ।। মামলা গ্রহন না করে বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে লালমাই উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়নের জয়শ্রী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩টি পরিবারের বিরোধ নিরসন করলেন লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকালে ৩টি পরিবারের সকল সদস্য ও গ্রামের গণ্যমাণ্যদের উপস্থিতিতে ওসি’র নিজ কক্ষে বিরোধ নিরসন বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, জয়শ্রী গ্রামের জোগেন্দ্র সিংহ রায় এর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া ৮ একর ২২শতক সম্পত্তির মালিক হন তিন ছেলে মৃনাল সিংহ রায় (ব্যবসায়ী), দিলীপ সিংহ রায় (স্কুল শিক্ষক) ও স্বপন সিংহ রায় (আদালতের পেশকার)। উক্ত সম্পত্তি তিন ছেলের নামে ২৮ নং ডিপি খতিয়ানে যথাক্রমে .৩৩৩, .৩৩৩ ও .৩৩৪ হিস্যায় লিপিবদ্ধ হয়। সেই অনুযায়ী তিন ভাই একমত পোষন করে মৌখিকভাবে বাড়ীসহ নাল জমি সমান হিস্যায় বন্টন করে ভোগদখল শুরু করেন। কিন্তু ১৮৯ নং বিএস চূড়ান্ত খতিয়ানে ভুলবশত: হিস্যা যথাক্রমে .৩০০, .৪০০ ও .৩০০ উল্লেখ করা হয়। যৌথ পরিবারে বসবাস করায় খতিয়ানে হিস্যার ভুল হলেও তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়নি। সেজন্য সংশোধনও করেননি। যৌথ সম্পত্তি থেকে পরিবারের প্রয়োজনে মৃনাল সিংহ রায় ও স্বপন সিংহ রায় বিভিন্ন সময়ে সম্পত্তি বিক্রি করেন। এরই মধ্যে ২০০৭ সালে দিলীপ সিংহ রায় ও ২০০৮ সালে মৃনাল সিংহ রায় মৃত্যুবরণ করেন। দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে তাদের সন্তানদের পাশে অভিভাবকের মতো ছায়া হয়ে দাঁড়ান স্বপন সিংহ রায়। ভাতিজারাও চাচাকে পিতৃসম্মানে অভিভাবক মেনেই নিজ নিজ পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করে আসছেন। স্বপন সিংহ রায় কয়েকবছর পূর্বে গ্রামের নিজ মালিকানাধীন সম্পত্তিতে (বাড়ীর অংশে) একটি ঘর নির্মাণ করেন। কিন্তু চাকরির কারনে কুমিল্লা শহরের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করায় নির্মিত ঘরটিতে বড় ভাই দিলীপ সিংহ রায়ের মেঝো ছেলে মৃদুল সিংহ রায়কে মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় বসবাস করতে দেন। একই সময়ে বাড়ীর পাশ্ববর্তী একটি ভিটি দিলীপ সিংহ রায়ের বড় ছেলে শিমুল কে শর্তসাপেক্ষে চাষাবাদ করতে দেন।
করোনা ভাইরাসের কারনে গত বছরের আগষ্ট মাসে স্বপন সিংহ রায় গ্রামের নিজ বাড়ীতে ফিরে আসতে চান। সেজন্য ভাতিজা মৃদুল কে ঘর ছাড়তে বলেন। মৃদুল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধ করে সময় চাইলে ঘরের মালিক স্বপন সিংহ রায় রাজি হন।
কিন্তু চলতি মাসের প্রথমে মৃদুল চাচাকে জানিয়ে দেন যে, তারা ঘর ও ভিটি ছাড়বে না। মৃদুলদের দাবী, বিএস খতিয়ানে হিস্যা যেভাবে আছে সেভাবে ভাগ হতে হবে। জেঠা ও চাচা যেসব সম্পত্তি বিক্রি করেছে সেগুলো ফেরত দিতে হবে। এতে ৩টি পরিবারে বিরোধ বাড়তে থাকে। সুযোগ পেয়ে বহিরাগত কিছু লোক হিন্দু পরিবার ৩টির বিরোধ বাড়াতে কু-পরামর্শ দেয়া শুরু করে।
গত কয়েকদিন আগে ভাড়া ঘর ও ভিটি জমি উদ্ধারে আইনি সহায়তার জন্য স্বপন সিংহ রায় একটি মামলা করতে লালমাই থানায় যান। কিন্তু থানার অফিসার ইনচার্জ পুরো ঘটনাটি শুনে মামলা না নিয়ে বিট পুলিশিং এর মাধ্যমে ৩টি পরিবারকে জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ গ্রামের গণ্যমাণ্যদের ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টায় থানায় আসতে বলেন। ওসি’র ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার আবুল কাশেম, জয়শ্রী গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাজী তৈয়ব আলী, গ্রাম প্রতিনিধি মাষ্টার আবু হানিফ, ডা: নারায়ন চন্দ্র দাস, মুজিবুর রহমান, কৃষকলীগ নেতা আবুল কালাম, মৃনাল সিংহ রায়ের ছেলে লিটন সিংহ রায়, জোটন সিংহ রায়, দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলে শিমুল সিংহ রায়, মৃদুল সিংহ রায়, পলাশ সিংহ রায়, স্বপন সিংহ রায় ও তার ছেলে শুভ্র সিংহ রায় থানায় উপস্থিত হন। থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক সারওয়ার মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওসি জমির বিভিন্ন কাগজপত্র দেখে ও সকলের কথা শুনে জয়শ্রী গ্রামের গণ্যমাণ্যদের সহায়তায় বিরোধ নিরসন করে দেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মৃদুল সিংহ রায় আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত স্বপন সিংহ রায়ের ঘর এবং শিমুল সিংহ রায় চলতি ফসল (টমেটো) শেষে ভিটি ফিরিয়ে দিবেন। তবে এক্ষতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চাচা ভাতিজা ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে একটি ভাড়া চুক্তিনামা করে নেবেন। স্বপন সিংহ রায় নিজের মালিকানাধীন অন্য একটি খতিয়ানের নাল ২২শতক জমি দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলেদের ফিরিয়ে দিবেন। মৃনাল সিংহ রায়ের ছেলেরাও ৪৪শতক জমি দিলীপ সিংহ রায়ের ছেলেদের ফিরিয়ে দিবেন। ভবিষ্যতে সময় সুযোগ করে সার্ভেয়ার দিয়ে ভোগ দখলীয় বাড়ীর সম্পত্তি পরিমাপ করে কোন সমস্যা থাকলে ওয়ার্ড মেম্বারের উদ্যোগে নিরসন করবেন। বিরোধ নিরসনের এক পর্যায়ে ভাতিজারা চাচা স্বপন সিংহ রায়ের পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন। এসময় থানার ওসির কক্ষে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারনা হয়। কোন প্রকার মামলা, অর্থ অপচয় বা হয়রানি ছাড়াই বিরোধ নিরসন হওয়ায় ৩টি পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ পুলিশ তথা লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন।

দিলীপ সিংহ রায়ের বড় ছেলে শিমুল সিংহ রায় বলেন, পুলিশের উদ্যোগে এতো সহজভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি হবে চিন্তাও করিনি। সম্পত্তিও ফিরে পেয়েছি, চাচাকেও আপন করতে পেরেছি।

স্বপন সিংহ রায় বলেন, ভাতিজা মৃদুলের দখল থেকে ঘর ও ভিটি উদ্ধারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে থানায় গেছি। কিন্তু কোন মামলা ছাড়াই শুধুমাত্র থানার ওসি মহোদয়ের আন্তরিকতায় সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।

লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, বিট পুলিশিং এর মাধ্যমে পারিবারিক ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমাজে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।