আমার পুলিশ ভীতি আর পুলিশ প্রীতি

418

মোআইনুল হক

আসামী হলে সবাই পুলিশ কে দারুন ভয় করে । আসামী হয়ে এক সময় আমিও প্রচন্ড ভয় করতাম আর ঘৃনা করতাম এ পুলিশ বাহিনী কে ।সেই আশির দশকে ছাত্র জীবনে পুলিশ এসল্ট কেসের আসামীও ছিলাম । ইহা ছাড়াও কলেজে মারামারী হোস্টেল ভাংচুর অগ্নি সংযোগ ইত্যাদী সহ আরো বেশ কয়েকটা মামলার আসামী হয়েছি । কত দিন কত রাত পুলিশী এরেস্ট হওয়ার ভয়ে কত জায়গায় পলাতক থেকেছি ।একবার এলাকার মাইছানির চরে আমার এক নানা বাডী. তে আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে থেকেছি । থেকেছি শীত কালে স্যালো মেশিন ঘরে সারা রাত।যেখানে ধানের জমিতে পানির সেচ চলতো ভট ভট শব্দে। খরের উপর চটের বিছানা ,তারপর কাথা গায়ে দিয়ে কি শান্তির ঘুম । এ ভাবে দিনের পর দিন পার করেছি পুলিশের ভয়ে । সকালে পান্তা ভাত আর পিয়াজ মরিচ কত মজাই না লাগতো । লাকরির চুলায় রাতে মিস্টিআলু পোড়া সকালে খেতে কি দারুন না লাগতো ।

দিনের বেলায় আমার সমবয়সী মামা তুতার সাথে ঝাকি জাল নিয়ে ব্রম্মপুত্র নদীতে মাছ ধরা কি আনন্দই না উপভোগ করেছি আসামী হঁয়ে পলাতক অবস্থায় । আমি জাল মারতে পারতাম না । তুতা মামা জাল মারতো আর আমি থাকতাম সাথে খলই নিয়ে পিছে পিছে। কম পানিতে মাথা ভাসিয়ে দিয়ে ঝাকে ঝাকে চলে এক প্রজাতির মাছ । আমাদের এলাকায় এই মাছ কে বলে ইংলা মাছ । দৌডে গিয়ে তুতা মামা ভাসমান সে মাছ গুলির উপর ঝাকি জাল মারতো পরে মাছ গুলি আমাকে দিতো । আমি সে গুলি খলই বন্দী করে রাখতাম । ১৯৮৩ সাল ,তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটে সেকেন্ড ইয়ারে পডি. । সে অনেক কথা , আসামী হওয়ার অনেক স্মৃতি । অনেক পুলিশ ভীতি ।যা না বললেই নয় তাই কিছু কিছু আলোকপাত করছি ।

সে সময় আসামী হয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে চর এলাকায় থাকা কালে একদিন দেখি কিছু খাকি পোষাক পড়া লোক চরের মধ্যে যেতে দেখে মনে হচ্ছিল যে পুলিশ আমাকে বোধহয় ধরতে আসছে । দৌড়……এ গ্রাম হতে ও গ্রামে অনেক দুরে । সারা দিন না খাওয়া পুরো উপোষ ।পরবর্তিতে জানতে পারি খাকি পোষাক পড়া লোক গুলি পুলিশ না ,ওরা গ্রাম্য চৌকিদার । সপ্তাহে একদিন থানায় হাজিরা দিতে যায় । সেই চৌকিদার কয়েকজন থানা হতে হাজিরা দিয়ে আসছিল । যা দেখে ভয়ে পগারপার আর কি !

কোর্টে আসামী হিসেবে কাঠ গড়াতে দাডিয়ে জামিন শুনানী কালে কত দোয়া দরুদ এই বুঝি জামীন আবেদন নাকচ করে হাজতে দিল । শুনানী কালে পুলিশও বেরিকেড দিয়ে কাঠের কাটগডায় আটকিয়ে রাখে কত ভয় সে সময় । প্রায়ই পুলিশ কে স্বপ্নে দেখতাম । স্বপ্নে পুলিশ দৌডিয়ে নিয়ে বেড়াতো । দৌডাতে দৌডাতে টায়ার্ড হয়ে পড়তাম । আরো কত কি ! ।

পুলিশ কে আপন ভাবিনি কখনো । পুলিশ কখনো মানুষ হঁয় না তাই ,ভাল বাসিনি কখনো । শুনেছি পুলিশ কে মা দিলে বাপ হয় না কখনো । তাই ঘৃনাই করেছি ।জেনে বা না জেনে …..

কেউ আসামী বা ভুক্তভোগী হয়ে পুলিশকে ঘৃনা করে আবার কেউ অন্যের কাছে শুনে শুনে ঘৃনা করে । এমনি আমিও পুলিশ কে না জেনেই ঘৃনা করতাম । কত বাজে মন্তব্য ও করতাম ।আমাদের সময়ে পুলিশ কে ঠোলা বলে কটুক্তি করতো । আজো জানিনা ঠোলা অর্থ কি ?

অবশেষে সেই পুলিশেই সরাসরি অফিসার পদে ভর্তি হলাম । সারদা ট্রেনিং এক বছর । তার পর আবার দুই বছর শিক্ষানবীস ।কত কত জায়গা কত জেলা ,কত উপজেলা ,কত থানা দেখলাম কর্তব্যের তাগিদে । কত বিচিত্র মানুষ দেখলাম । কত পথ ঘাট মাডি.য়ে সন্চিত কত অভিজ্ঞতার ঝুরি মাথায় নিয়ে ঘুরছি আর ঘুরছি !ত্রিশটা বছর !কত স্মৃতি ,কত গা শিউরে উঠার মত ঘটনা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা যা বলতে গেলে পৃষ্টার পর পৃষ্টা লিখেও শেষ করা যাবে না ।

আমার এক সময়কার ঘৃনার সে পুলিশ বিভাগ যে কত মহান তা নিজে পুলিশ না হলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতাম না । পুলিশ হয়েছি বলেই পুলিশ সম্পর্কে ধারনা পাল্টে গেছে । কত মানবিক পুলিশ দেখেছি এ বিভাগে । কত শত বিবেকবান নীতি নৈতিকতার পুলিশ দেখেছি ! কতো চৌকস ও জাঁদরেল পুলিশ দেখেছি ।তবে দৃঢ. ভাবে বলতে পারি লোভ লালসার উর্ধে থেকে একটু বিবেকের সাথে চলতে পারলে এর চেয়ে মহৎ পেশা আর নাই । এ পেশায় মানুষ কে প্রত্যক্ষ ভাবে যে সেবা করা যায় তা অন্য পেশাঁয সম্ভব না । আমাকে আমি জাজম্যান্ট করতে পারবো না বলেই জানিনা কতটুকু সে রকম পুলিশ হতে পেরেছি । তবে পুলিশ বিভাগের একজন সদস্য হতে পেরে নিজেকে গর্ববোধ করি । মহান এ পেশায় জনগনকে কিছু টা দিতে চেষ্টা করতে পেরে নিজ কে ধন্য মনে করি ।চেস্টা করেছি বিবেকের সাথে চলতে । জানামতে বিবেক বিবর্জিত কোন কাজ করিনি । লোভের বশবর্তি হঁয়ে কখনো মাথা বিক্রি করিনি , বিচার বিক্রি করিনি । বাকী সময়েও যেন না করতে হয় সে চেস্টা করবো ।

জানি সামনে পড়লে ভয়ে ছালাম কালাম দিলেও একটু আড়ালে গেলেই সমালোচনা আর ঘৃনা । যা নয় তাও পুলিশের বিরুদ্ধে বাডিয়ে বলা যেন কিছু মানুষের স্বভাব ।কিছু কিছু মানুষ অযথাই পুলিশের বিরুদ্ধে এহেন মিথ্যে ও বানোয়াট তথ্য পরিবেশন করে পুলিশ বিভাগ কে পচাতে একটুও দ্বিধা করে না । কারন পুলিশ কিন্ত বিবদমান দুটি পক্ষের দুই গ্রুপকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না । যে পক্ষটা অপরাধ করে সেই পক্ষটাই দোষারুপ করতে থাকে সারা জীবন ।

বিংশ শতাব্দীর পুলিশ যে আজ কত আশির্বাদ তা সাম্প্রতিক বহূল ঘটনাবলী ও পরিস্থিতি বলে দেয় । । জনগনের জন্য কি না করছে পুলিশ ! উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এ দেশের পুলিশ বাহিনী দিন রাত বিরামহীন ভাবে

আপনার ঘর পাহাডা দেয়া হতে শুরু করে সমাজে আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন সহ শান্তি আনয়নে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে । আপনি ঘুমান পুলিশ রাস্তায় পাহাডা. দেয় সারারাত জেগে । আপনার সম্পদ ,টাকা পয়সা হতে মুল্যবান নগদ জিনিস পত্রের

নিরাপত্তায় সর্বদা নিয়োজিত এ পুলিশ বাহিনী । ব্যাক্তি নিরীপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা , সামাজিক নিরাপত্তা , রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সর্বোপরি এ দেশের মানুষের জান মাল হেফাজতের দায়িত্ব ও আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন করে দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ পুলিশ বাহিনী । পুলিশ এ দেশের মানুষের মনের কোঠায় কত টুকু জায়গা করে নিয়েছে সমাজ সোসাইটি তা নিরুপন করবে ।

আমরা সাধারন অনেকেই হয়তো জানিনা ৭১ মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে এ পুলিশ বাহিনী । প্রথম শহীদ হঁয় এ পুলিশ বাহিনী । শুধু তাই নয় রনাংগনে ও পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শত শত পুলিশ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে । স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে এ পুলিশ বাহিনীর অবদান অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।

। আমি বাডিয়ে কিছুই বলছি না । এদেশের আধুনিক পুলিশ বাহিনী উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের পুলিশের চেয়েও সুনামও নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে । দেশে করোনা মহামারী ক্রান্তি কালে মানব সেবায় উদ্ভাসিত এ পুলিশ বাহিনী যেন অতিতের সব রেকর্ড ভংগ করে মানবতার সেবায় সমুজ্জল হয়ে উন্নত শির হঁয়ে দন্ডায়মান । তাই আজ কে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ পুলিশের জয়জয়কার! মানুষ মানুষের জন্য … জীবন জীবনের জন্যে … সেই ব্রত নিয়ে পুলিশ বাহিনী আত্মাহুতি দিয়েও এ দেশের জন মানুষের বিপদে পাশে থেকে সহযোগীতা সেবা করে যাচ্ছে । এ দেশের জনগনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচানোর জন্য প্রানপন লড়াই করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ ।

অস্বীকার করার উপায় নাই ,যা দায়িত্বের মধ্যে আছে তাও করছে যা নাই তাও করে যাচ্ছে এ দেশের পুলিশ ,শুধু মানুষ কে বাঁচাবার জন্যে ।

সম্প্রতি করোনা যুদ্ধ !যে যুদ্ধে সারা বিশ্ব লড়ছে। বাংলাদেশও লডছে । প্রতিটা মানুষ কি এক বিভিষিকা ময় দিন রাত সপ্তাহ মাস পাড়. করছে মারাত্নক উদ্বিগ্নের মধ্যে । কাটছে সারাক্ষন শুধু মৃত্যুভয় আর উৎকন্ঠায় । দূ:খ জনক হলেও সত্যি যে ,মানুষের মধ্যে মায়া মমতা ভাল বাসা যেন আজ বিলীন হতে যাচ্ছে । প্রতিবেশী হতে শুরু করে পাডা মহল্লায় আজ মানুষের মধ্যে মানবতা উঠে গেছে । করোনা আক্রান্ত হলেই পাডা মহল্লা হতে বের করে দেয়া , আক্রান্ত ব্যাক্তির বাডী ঘর ভাংচুর করা ,ভয় ভীতি দেখানো ইত্যাদী বিবেকহীন কাজ কর্ম সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছে । একটুও অনুধাবন করি না যে যেকোন মুহূর্তে নিজেও আক্রান্ত হতে পারি , মারা যেতে পারি । তখন কি অন্যরা কিভাবে মেনে নিবে ।

মানুষ যেখানে মানুষের না ঠিক সে রকম পরিস্থিতিতে পুলিশ মানবের কল্যানে ঢালস্বরুপ এগিয়ে এসেছে।

গর্ভবতী মা কে কোলে করে নিয়ে প্রসব বেদনার ফলে রক্তপাতে পোষাক রংগীন করে রুগীকে হাসপাতালে নিয়ে প্রসব করানো যে কত আত্মতৃপ্তি সে কাজটিও করছে পুলিশ বাহিনী । যাত্রী বাহী বাস দূর্ঘটনার পানিতে তলিয়ে যাছ্ছে সবাই যেখানে তাকিয়ে দেখছে অথচ জীবন বাজী রেখে নিমিষেই ঝাপিয়ে পড়ে নিমজ্জিত প্রায় বাসের সকল যাত্রীকে উদ্ধার করে বীরের ভূমিকায় এ পুলিশ বাহিনী

করোনা যুদ্ধে রুগীদের হাসপাতালে আনা নেয়া , ঘরে ঘরে খাদ্য পৌছে দেয়া , ঔষধ পথ্য পৌঁছানো হতে শুরু করে নিজের বেতনের পয়সা দিয়ে ক্ষুধার্থ মানুষ গুলির মানুষের পাশে দাঁড়ানো , করোনায় মারা গেলে পরিবার পরিজন প্রতিবেশী যেখানে কেউ যাচ্ছে না লাশের সৎকার করতে আজ পুলিশ জীবন বাজী রেখে লাশের দাফন কাফন হতে শুরু করে সব কিছু করে যাচ্ছে ।

স্ত্রী পরিজন ফেলে রেখে দিনের পর দিন রন ক্ষেত্রে যুদ্ধে অবিরত এ পুলিশ বাহিনী । জানিনা কবে এ যুদ্ধের পরিত্রান হবে ।শত শত পুলিশ সদস্য এ দেশের মানুষের পার্শে দাঁড়াতে গিয়ে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন । তিন জন বীর যুদ্ধা আত্নাহুতি দিয়েছেন ।বাংলাদেশ পুলিশ প্রসংশায় ভাসছে জনমনে দেশে বিদেশে । স্যালুট বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে । আর এ বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে আমি গর্বিত ।

লেখকঃ মো: আইনুল হক, এএসপি, বাংলাদেশ পুলিশ।